রাজধানীর উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চালুতে যাতায়াতে সাধারণ মানুষের মাঝে নেমে এসেছিল স্বস্তি। কিন্তু এই স্বস্তির মাঝে নানা বিড়ম্বনায় যাত্রীদের মধ্যে ক্রমেই বাড়ছে অস্বস্তি। ভেন্ডিং মেশিন নষ্ট, একক যাত্রার টিকিটের সংকট, যান্ত্রিক কিংবা বৈদ্যুতিক ত্রুটিতে রেল বন্ধ, পকেটমারের উৎপাত, যৌন হয়রানি, স্টাফদের খারাপ আচরণসহ নানাবিধ সমস্যায় বেড়ে চলেছে যাত্রী অসন্তোষ।
মতিঝিল থেকে উত্তরাগামী মেট্রোরেলে যাতায়াতকালে এক নারী ও তার শিশুকন্যা গত ৫ মার্চ যৌন হয়রানির শিকার হন বলে অভিযোগ উঠেছে। ঘটনার দিনই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ঘটনা তুলে ধরেন ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা নিলুফার পারভিন।
পেশায় চিকিৎসক নিলুফার পারভিন জানান, মেট্রোরেলে নারীদের জন্য সংরক্ষিত একমাত্র বগিতে ১০-১২ জন পুরুষ উঠে পড়ে। তাদেরই কারও দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়ে ফার্মগেট স্টেশন ছাড়ার পর কাঁদতে কাঁদতে ওই নারী তার শিশুকন্যাকে নিয়ে গেটের কাছে এসে যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার কথা বলেন।
আবার ৬ মার্চ মতিঝিল স্টেশনে মেজবা উদ্দিন নামে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের এক কর্মকর্তার পকেট থেকে ২৫ হাজার কানাডিয়ান ডলার খোয়া যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এর আগে গত ২ জানুয়ারি নাঈম ইসলাম সোহাগ নামে এক যাত্রী পকেটমার থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পাওয়ার বিবরণ লেখেন ‘মেট্রোরেল প্যাসেঞ্জার কমিউনিটি’নামে একটি ফেসবুক পেজে।
যৌন হয়রানির বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে জানিয়ে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক আহমেদ বলেন, নিষেধ থাকা সত্ত্বেও নারীদের কামরায় পুরুষ উঠে পড়াটা খুবই দুঃখজনক। এরই মধ্যে যাত্রীদের নিরাপত্তায় প্রতিটি ট্রেনে পুলিশ দায়িত্ব পালন করছে। নারীদের নির্ধারিত কামরার পাশে যেন তারা অবস্থান করে সে নির্দেশনাও দেওয়া রয়েছে।
তিনি বলেন, এসব বিষয় নিয়ে আমি এমআরটি পুলিশের ডিআইজির সঙ্গেও কথা বলেছি।
সব শ্রেণি-পেশার মানুষের নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যে যাতায়াতের বাহন মেট্রোরেল ক্রমেই যেন অনিরাপদ হয়ে উঠছে। মেট্রোতে যাতায়াতকালে মাঝেমধ্যেই ঘটছে পকেটমার, যৌন হয়রানিসহ নানা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। এরই মধ্যে পকেটমার থেকে সাবধানে থাকার পরামর্শ ও সতর্কবার্তা দিচ্ছে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ। তবে এসব ঘটনা বন্ধে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ এখনো জানা যায়নি।
এ ছাড়া শাহবাগসহ মেট্রোরেলের বিভিন্ন স্টেশনের ভেন্ডিং মেশিন মাঝেমধ্যেই নষ্ট থাকে। ফলে স্টেশনের টিকিট অফিস মেশিনে (টিওএম) যাত্রীদের দীর্ঘ লাইন থাকে। তবে যাদের কাছে এমআরটি পাস রয়েছে, তারা নির্দ্বিধায় স্টেশনে ঢুকে রেলে যাতায়াত করছেন।
নিউমার্কেটের ব্যবসায়ী শামসুল আলম। ব্যবসায়িক কাজে মাঝেমধ্যেই মিরপুরে যাতায়াত করতে হয়। তিনি বলেন, শাহবাগ মেট্রোরেল স্টেশনে টিকিট কাটতে গেলে ভেন্ডিং মেশিন নষ্ট থাকায় প্রায়ই দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এ ছাড়া মাঝেমধ্যেই ভেন্ডিং মেশিনে লেখা দেখা যায়, ‘লেনদেন প্রক্রিয়াটিতে ত্রুটি আছে, অপেক্ষা করুন। সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত।’ আবার টিওএমে ভাংতি টাকার অভাবে অনেক সময় টিকিট কিংবা একক যাত্রার টিকিট পেতেও সমস্যা হয়।
অভিযোগ রয়েছে, সঠিক তদারকির অভাবে মেট্রোরেল পরিচালনায় চরম অব্যবস্থাপনা দেখা দিয়েছে। ফলে দিন দিন বাড়ছে যাত্রীদের ভোগান্তি। এর জন্য মূলত মেট্রোরেল নির্মাতা ও পরিচালনা সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড-ই (ডিএমটিসিএল) দায়ী। যাত্রী ভোগান্তি দূর করতে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষকে আরও সচেতন হতে হবে।
তবে ডিএমটিসিএল কর্মকর্তাদের দাবি, যাত্রীদের নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যে যাত্রা নিশ্চিতে তাদের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই। শিগগির পর্যাপ্ত একক যাত্রার টিকিট আমদানি করা হচ্ছে। এ ছাড়া ভেন্ডিং মেশিন ঠিক করাসহ অন্যান্য সমাস্যা সমাধানেও তারা দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছেন।
ডিএমটিসিএলের মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) মোহাম্মদ ইফতিখার হোসেন বলেন, এরই মধ্যে পর্যাপ্ত একক যাত্রার টিকিট আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ভেন্ডিং মেশিনের ত্রুটি পাওয়া মাত্র তা ঠিক করা হচ্ছে। এদিকে প্রতিটি টিওএমে সংশ্লিষ্টদের পর্যাপ্ত ভাংতি টাকা রাখতে বলা হয়েছে।
তিনি বলেন, যাত্রীদের দ্রুত ও আরামদায়ক যাতায়াতে ঢাকার জনপ্রিয় গণপরিবহন মেট্রোরেল। তবে কিছু ব্যক্তির দায়িত্বজ্ঞানহীন কর্মকাণ্ডে মেট্রোরেল চলাচলে বেশ কয়েকবার বিঘ্ন ঘটে। এসব সমস্যা সমাধানে জনসচেতনতার বিকল্প নেই।
এদিকে মাঝেমধ্যেই মেট্রোরেলের স্টাফদের বিরুদ্ধে আনা হচ্ছে অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগ। বিশেষ করে মেট্রোরেলে যারা নতুন যাতায়াত করছেন তারাই এ সমস্যার বেশি সম্মুখীন হচ্ছেন বলে জানা যায়। এ ব্যাপারে মেট্রোরেল প্যাসেঞ্জারস কমিউনিটি-ঢাকা ফেসবুক পেজে প্রায়ই অভিযোগ দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, শুরুতে দক্ষ ব্যক্তি নিয়োগ না দেওয়ায় মেট্রোরেল কাঙ্ক্ষিত সেবা নিশ্চিত করতে পারেনি। বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগের পূর্ব পর্যন্ত এ সংস্থাটির প্রধান এ পদটি আমলানির্ভর ছিল, যাদের কারিগরি কোনো জ্ঞান নেই। ফলে এর ব্যয় অনেক বেড়েছে।
তিনি বলেন, মেট্রোরেল স্টেশনগুলোতে হুটহাট ভেন্ডিং মেশিন নষ্ট হচ্ছে। এ ছাড়া যখন-তখন মেট্রোরেল বন্ধ হচ্ছে। ফলে যাত্রী দুর্ভোগ লেগেই থাকছে।