গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশের ব্যাংক খাতে যে লুটপাট ও অর্থপাচারের অভিযোগ রয়েছে, তা তদন্তে বিশ্বখ্যাত তিনটি নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান— ইওয়াই, ডেলয়েট ও কেপিএমজিকে নিয়োগ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
যুক্তরাজ্যের সংবাদপত্র ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে (এফটি) রোববার (২৬ জানুয়ারি) দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এ তথ্য জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।
অভিযোগ রয়েছে, বিগত সরকারের আমলে ব্যাংক খাত থেকে প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলার আত্মসাত করেছে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ও ব্যবসায়ীরা।
যে ছয়টি ব্যাংক লক্ষ্য রেখে সেগুলোর সম্পদের অবস্থা পর্যালোচনায় নিরীক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তার মধ্যে পাঁচটির শেয়ার সিঙ্গাপুরে বসবাসকারী বাংলাদেশি ব্যবসায়ী মোহাম্মদ সাইফুল আলম নেতৃত্বাধীন এস আলম গ্রুপের হাতে রয়েছে।
পাচার করা অর্থ দিয়ে কেনা সম্পদ খুঁজে বের করতে এবং দায়ীদের বিচারে সহায়তা করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ১১টি যৌথ তদন্ত দল গঠন করেছে বলেও গভর্নর সাক্ষাৎকারে এফটিকে বলেছেন।
তিনি জানান, তদন্তে বাংলাদেশের শীর্ষ ১০টি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার আত্মীয়রা নজরদারিতে থাকবেন।
এ ব্যাপারে ইতোমধ্যে তিনটি আর্থিক পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান ‘অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ’ শুরু করেছে বলে উল্লেখ করেন আহসান এইচ মনসুর।
তিনি বলেন, পর্যালোচনার মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর সম্পদ মূল্যায়ন করা হবে এবং খুঁজে বের করা হবে কোন সম্পদ কার্যকর এবং কোনগুলো অকার্যকর। এছাড়া, কারা এই সম্পদগুলো নিয়েছে এবং কীভাবে সেগুলো ব্যবহৃত হয়েছে, তা বের করতে একটি ফরেনসিক অডিটও করা হবে।
আর্থিক নিরীক্ষা ও পরামর্শ সেবা দিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে সুনাম করেছে কেপিএমজি। সংস্থাটি জানিয়েছে, তারা তাদের শ্রীলঙ্কার কার্যালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে ব্যাংক খাতের অনিয়ম পর্যালোচনায় সহায়তা করবে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ বিষয়ে অন্য দুটি প্রতিষ্ঠান- ইওয়াই ও ডেলয়েটের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কর্মঘণ্টা অতিবাহিত হওয়ায় কোনও মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। আর ইমেইলের মাধ্যমে কেপিএমজির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাড়া মেলেনি।
গভর্নর আহসান এইচ মনসুর দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক মু্দ্রা তহবিলে কাজ করেছেন। তিনি জানান, তার কাজ হলো বাংলাদেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করা এবং পাচার হওয়া অন্তত ২ ট্রিলিয়ন (১৬.৪৬ বিলিয়ন ডলার) টাকা উদ্ধার করা—যেগুলো তার মতে, শেখ হাসিনার শাসনামলে আত্মসাৎ করা হয়েছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দায়িত্বে আসে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এরপর আহসান এইচ মনসুর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব পান।
এর আগে গত বছরের অক্টোবর মাসে ফিনান্সিয়াল টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মনসুর বলেছিলেন, দেশের বেশ কিছু শীর্ষ ব্যাংক সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার (ডিজিএফআই) সহায়তায় দখল করা হয়েছিল, কিছু ক্ষেত্রে ‘অস্ত্রের মুখে’। এর মধ্যে এস আলমের দখল করা ব্যাংকগুলোর কথাও উঠে আসে।
মনসুর বলেন, এই তদন্তের অংশ হিসেবে, এসব ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের ছুটি নেয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে, যাতে সম্পদের মান যাচাইয়ে কোনও বিঘ্ন না ঘটে।
এছাড়া, বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চলতি মাসে এস আলমের দুই পুত্রসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নিয়ে ১১ দশমিক ৩ বিলিয়ন টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলা দায়ের করেছে। মামলা সংশ্লিষ্ট একাধিক সম্পত্তি জব্দের নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকার আদালত।
এস আলমের আইনজীবী কুইন এম্যানুয়েল উরকহার্ট অ্যান্ড সুলিভানের বক্তব্য নিয়ে ফিন্যান্সিয়াল টাইমস। তিনি জানান, তিনি এবং তার ব্যবসায়ীরা ‘কোনও অন্যায় কাজ করেননি এবং যদি প্রয়োজন হয়, তারা বাংলাদেশের মধ্যে তাদের বিনিয়োগ রক্ষা করার জন্য আইনি পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত’।
এস আলম ও তার গ্রুপের বিনিয়োগকারীরা ‘স্বচ্ছতা এবং আন্তর্জাতিক মানের তদন্তকে স্বাগত জানায় উল্লেখ করে সুলিভান বলেন, তবে তারা মনে করে ব্যাংকিং খাত সংস্কারে ইউনূস সরকারের টাস্কফোর্সের প্রধান হিসেবে কাজ করার কারণে মনসুরের ভূমিকা পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে।
গত ডিসেম্বরে ইউনূস সরকারকে সতর্ক করে একটি চিঠি দিয়েছিল এস আলমের আইনজীবীরা। সেখানে তারা বলেন, তারা ঢাকার সঙ্গে তাদের বিরোধ নিষ্পত্তি করতে না পারলে আন্তর্জাতিক সালিশে যেত প্রস্তুত আছেন। এস আলম ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে অর্থপাচার এবং অন্য কোনও অভিযোগ ‘ভিত্তিহীন’।
দেশের বাইরে পাচার হওয়া অর্থ খুঁজে বের করতে এবং পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টায় আন্তর্জাতিক সহায়তাও নিচ্ছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার। এর মধ্যে রয়েছে- যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী সমন্বয় কেন্দ্র এবং যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগ। ট্রেজারি বিভাগ প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের উপদেষ্টাদের কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে, কারণ বাংলাদেশ অন্য দেশ থেকে আইনি সহায়তা চাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে আর্থিক সম্পৃক্ততার অভিযোগের ঘটনায় তার ভাগনি ও লেবার পার্টির সিটি মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিক পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। এবার দাবি উঠেছে, তাকে এমপি থেকে পদত্যাগ করতে হবে।
টিউলিপের পদত্যাগের বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। তাদের ধারণা, টিউলিপের পদত্যাগ, হারানো অর্থ পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টায় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আরও মনোযোগ আকর্ষণ করবে।
তবে সিদ্দিকের মুখপাত্র জানিয়েছেন, টিউলিপের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের কোনও প্রমাণ নেই এবং তিনি এই অভিযোগগুলো সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেছেন।
জনগণের চাপের কারণে টিউলিপ সিদ্দিক পদত্যাগ করেছেন মন্তব্য করে মনসুর বলেছেন, আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া দেখে উৎসাহিত। রাজনীতিবিদরা এ নিয়ে সচেতন আছেন এবং আশা করি, তারাও তাদের দেশের ভেতরে জনগণের চাপের কাছে নত হবে এবং অর্থ পুনরুদ্ধারের এই প্রচেষ্টাকে সমর্থন করবে।