সহযোদ্ধা, সহশিল্পী ও স্বজনদের শ্রদ্ধার ফুল এবং রাষ্ট্রীয় সম্মানে সিক্ত হয়ে চিরবিদায় নিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী সুজেয় শ্যাম।
শুক্রবার ( ১৮ অক্টোবর) সোয়া ১১টার দিকে সুজেয় শ্যামের মরদেহ নিয়ে আসা হয় ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে৷
এরপর ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই গীতিকার ও সুরকারের কফিন মুড়িয়ে দেয়া হয় জাতীয় পতাকায়। পুলিশের একটি চৌকশ দল সেখান এই শিল্পীকে গার্ড অব অনার দেয়। এসময় বিউগলে বাজানো হয় করুণ সুর।
সুজেয় শ্যামকে শ্রদ্ধা জানাতে ঢাকেশ্বরীতে এসেছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের তার সহশিল্পী গায়িকা শাহীন সামাদ, গায়ক তিমির নন্দী, অভিনেতা-নির্দেশক মামুনুর রশীদ, সঙ্গীতশিল্পী খোরশেদ আলম, শুভ্র দেব, বিজন চন্দ্র মিস্ত্রিসহ অনেকে৷
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ, মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির পাশাপাশি ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনেকে শ্রদ্ধা জানান সুজেয় শ্যামের মরদেহে।
পরে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় বাসাবোর সবুজবাগে বরদেশ্বরী কালীমাতা মন্দিরে। সেখানেই দুপুরে সুজেয় শ্যামের মরদেহ সৎকার সম্পন্ন হয় বলে জানান তার মেয়ে লিজা।
ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃহস্পতিবার রাত ৩টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সুজেয় শ্যাম মারা যান বলে জানিয়েছেন তার মেয়ে রূপমঞ্জুরী শ্যাম লিজা।
শরীরে ক্যান্সার নিয়েই কাটছিল সুজেয় শ্যামের দিন; সঙ্গে ডায়েবেটিস, কিডনিসহ নানা জটিল রোগও ছিল।
গত জুন মাসেও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এই শিল্পী। গত সেপ্টেম্বর তার হার্টে পেসমেকার বসানোর পর ইনফেকশন হয়ে যায় বলে জানিয়েছেন লিজা। লিজা বলেন, বাবার পেসমেকার বসানোর কারণে ইনফেকশন হলে গত ২৪ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি করেছিলাম। ওই সময় আইসিইউতে শয্যা খালি না থাকায় তাকে সিসিইউতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল।
১৯৪৬ সালে সিলেটে জন্ম নেয়া সুজেয় শ্যামকে সংগীতে অবদানের জন্য ২০১৮ সালে একুশে পদক দেওয়া হয়। তার আগে ২০১৫ সালে শিল্পকলা পদক পান তিনি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে সুজেয় শ্যামের নাম। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নয়টি গানে সুর করেছিলেন সুজেয় শ্যাম, যেগুলো একাত্তরের জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত গাওয়া হয়েছিল।
এর মধ্যে রয়েছে ‘মুক্তির একই পথ সংগ্রাম’, ‘ওরে শোনরে তোরা শোন’, ‘রক্ত চাই রক্ত চাই’, ‘আজ রণ সাজে বাজিয়ে বিষাণ’, ‘আহা ধন্য আমার’,‘আয়রে চাষী মজুর কুলী’।
তার সুর করা গানের মধ্যে ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি’ এবং ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ গান দুটি বাংলাদেশের যে কোনো জাতীয় দিবসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ যখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে, তখনই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সুরকার ও সংগীত পরিচালক সুজেয় শ্যামকে বলা হল, বিজয়ের গান করতে।
এরপর শহীদুল ইসলামের লেখা ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই/ খুশির হাওয়ায় উড়ছে/ উড়ছে উড়ছে উড়ছে/ বাংলার ঘরে ঘরে’ গানটিতে সুর করেন সুজেয় শ্যাম।
মাত্র ১৫ মিনিট লেগেছিল গানটি লেখা ও সুর করতে; এরপর রেকর্ডিং। আর পুরো গানটার জন্ম হয়েছিল মাত্র এক ঘণ্টায়।
গিটার বাদক ও শিশুতোষ গানের পরিচালক হিসেবে ১৯৬৪ সালে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান চট্টগ্রাম বেতারে কর্মজীবন শুরু হয় সুজেয় শ্যামের। পরে তিনি ঢাকা বেতারে যোগ দেন।
১৯৬৯ সালে চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন সুজেয় শ্যাম। ঢাকাই চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য তিনবার শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক হিসেবে তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন।
বাংলাদেশ বেতারের প্রধান সংগীত প্রযোজক পদ থেকে ২০০১ সালে অবসরে যান সুজেয় শ্যাম।
২০০৬ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ বেতারে প্রচারিত ৪৬টি গানের সংকলন নিয়ে ‘স্বাধীন বাংলা বেতারের গান’ শিরোনামে একটি অ্যালবামের সংগীত পরিচালনা করেন তিনি।