দীর্ঘদিন যাবৎ ইরান ও ইসরাইলকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের ঝুঁকি। সেই ঝুঁকি রীতিমতো হুমকিতে পরিণত হয়েছে। ইসরাইলে মঙ্গলবার রাতে ইরানের ভয়াবহ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা এবং তাকে কেন্দ্র করে পাল্টাপাল্টি হুমকিকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা এখন চরম পর্যায়ে। যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পাওয়া ইসরাইল এই ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জবাব দেয়ার অঙ্গীকার করেছে।
অন্যদিকে ইরান বলেছে, ইসরাইল জবাব দিলে এর পাল্টা জবাব হবে আরও ভয়াবহ। এমনিতেই গাজায় এ শতাব্দীর সবচেয়ে নৃশংসতম হামলা চালিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে চলেছে ইসরাইল। তাতে বিবেকসম্পন্ন মানুষসহ মুসলিম বিশ্বে ক্ষোভের আগুন জ্বলছে। তার ওপর পাশের দেশ লেবাননে হিজবুল্লাহ’র বিরুদ্ধে ভয়াবহ যুদ্ধ শুরু করেছে ইসরাইল। সেখানেও তারা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে বেসামরিক এলাকায় ভয়াবহ হামলা চালাচ্ছে। এতে বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছেন। এর ওপর স্থল হামলা শুরু করেছে। ফলে এই উত্তেজনা আকস্মিকভাবে দাবানলের মতো গ্রাস করতে পারে মধ্যপ্রাচ্যকে।
অনেক বিশ্লেষক বলছেন, এখান থেকে শুরু হয়ে যেতে পারে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ক্ষোভে ফুঁসছে ইয়েমেনের হুতিরা। ইরাকের রয়েছে কড়া বার্তা। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান সাবধান করেছেন। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরাঁকে ইসরাইলে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ইসরাইল। তাকে সেখানে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে।
ইসরাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরাইল কাটজ জাতিসংঘ মহাসচিবকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, জাতিসংঘের ইতিহাসে তিনি কলঙ্কিত হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তাকে আমি ইসরাইলে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করছি। আমাদের দেশে তার প্রবেশ নিষিদ্ধ। যেকোনো ব্যক্তি, যারা ইরানের হায়েনার মতো হামলায় দ্ব্যর্থহীনভাবে নিন্দা জানাবে না, তারা ইসরাইলের মাটিতে পা রাখার অধিকার রাখতে পারেন না।
তিনি অভিযোগ করেন, জাতিসংঘ মহাসচিব গুতেরাঁ হামাস, হিজবুল্লাহ, হুতি এবং এখন ইরানের সন্ত্রাসী, ধর্ষক ও খুনিদের সমর্থন দিচ্ছেন। মধ্যপ্রাচ্যের এ পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলেছে রাশিয়া। বুধবার ক্রেমলিনের মুখপাত্র দমিত্রি পেসকভ বলেছেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতি সবচেয়ে উদ্বেগজনক। যা ঘটছে তার প্রেক্ষিতে আমরা সব পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি। এ নিয়ে সব পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে রাশিয়া।
যেসব হামলায় বেসামরিক মানুষ নিহত হন, তার নিন্দা জানিয়েছে তারা। ওদিকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানোর আহ্বান জানিয়েছেন ইসরাইলের সাবেক দু’জন প্রধানমন্ত্রী। তারা হলেন- নাফতালি বেনেট এবং ইয়াইর লাপিদ। এর মধ্যে ইয়াইর লাপিদ সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেন, লেবানন, গাজা ও ইরানকে সন্ত্রাসীদের আস্তানা বলে অভিহিত করেন।
জরুরি বৈঠকে বসছে নিরাপত্তা পরিষদ
মধ্যপ্রাচ্য সংকট নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসার কথা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের। ইসরাইলের অভ্যন্তরে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পরপরই জরুরি ভিত্তিতে এই বৈঠকে বসার সিদ্ধান্ত হয়। এ খবর দিয়েছে অনলাইন আল-জাজিরা। এতে বলা হয়, নিরাপত্তা পরিষদকে লেখা চিঠিতে জাতিসংঘে নিযুক্ত ইসরাইলের রাষ্ট্রদূত ড্যানি ড্যানন জানান, ইসরাইলকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে ইরান। এই অভিযোগ তুলে ইরানের নিন্দা এবং দেশটির ইসলামিক রেভ্যুলুশনারি গার্ড কর্পসকে (আইআরজিসি) একটি ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করতে নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। তবে ইরানের দাবি, গাজা উপত্যকায় ও লেবাননে ইসরাইলি হত্যাযজ্ঞের প্রতিশোধ এবং হামাস, হিজবুল্লাহ ও আইআরজিসি’র নেতাদের গুপ্তহত্যার জবাবে তারা ইসরাইলে এই ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে।
‘মাশুল দিতে হবে ইরানকে’
‘ইরান মঙ্গলবার রাতে একটি বড় ভুল করেছে- এর জন্য তারা মাশুল দেবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। মঙ্গলবার রাতে ইসরাইলে ইরানের ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর এক নিরাপত্তা বৈঠকে এই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন নেতানিয়াহু। তিনি বলেছেন, ইরান সরকার নিজেদের রক্ষা করার জন্য আমাদের সংকল্প এবং আমাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের সংকল্প বুঝতে পারেনি।
হামাস, হিজবুল্লাহ সংগঠনের প্রধান এবং ইরানের এক কমান্ডারকে হত্যার দায়ে ইসরাইলে এ হামলা চালিয়েছে বলে তেহরান দাবি করেছে। হামলার পর তেহরানকে কড়া সতর্কবার্তা দিয়েছেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, ইসরাইলে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ব্যর্থ হয়েছে। এ ছাড়া তিনি ইরানের হামলার প্রতিশোধ নেয়ারও অঙ্গীকার করেছেন।
ইসরাইল প্রতিশোধ না নিলে হামলা এখানেই শেষ: ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী
ইসরাইল পাল্টা প্রতিশোধ নেয়ার সিদ্ধান্ত না নিলে তাদের লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শেষ হয়েছে বলে জানিয়েছে ইরান। কিন্তু তেলআবিব যদি পাল্টা হামলা চালায় তাহলে তার জবাব আরও কড়াভাবে দিতে প্রস্তুত তেহরান। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি বুধবার এক্সের এক পোস্টে এ কথা জানান।
তিনি বলেন, ইসরাইলি সরকার আরও প্রতিশোধ নেয়ার সিদ্ধান্ত না নিলে আমাদের পদক্ষেপ শেষ। তবে পরিস্থিতি অনুযায়ী আমাদের প্রতিক্রিয়া আরও শক্তিশালী এবং ভয়াবহ হবে।
এ খবর দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, মঙ্গলবার রাতে ইসরাইলকে লক্ষ্য করে ১৮০টির বেশি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে ইরান। এর বিপরীতে তেহরানকে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছে ইসরাইল। অবশ্য ইসরাইলের কড়া বার্তার পর ইরানও ইসরাইলকে লক্ষ্য করে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে। ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্র তেহরানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়ায় মধ্যপ্রাচ্যে বিস্তৃত যুদ্ধের আশঙ্কা তীব্র হয়েছে।
মূলত এই অবস্থা এড়াতে আপাতত ইসরাইলে আর কোনো হামলা না করার কথা জানিয়েছে তেহরান। এদিকে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের যুদ্ধবিরতির আহ্বান সত্ত্বেও এখনো হিজবুল্লাহ-ইসরাইলের মধ্যে তুমুল লড়াই অব্যাহত রয়েছে।
বুধবার সকালে ইরান সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ’র বৈরুতে অবস্থিত শক্তিশালী একটি ঘাঁটিতে নতুন করে বোমা হামলা করে ইসরাইল। হিজবুল্লাহকে লক্ষ্য করে এই কয়েক ডজন বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। হামলার পরপরই ওই এলাকার কিছু অংশে ধোঁয়ার বড় ফোয়ারা উঠতে দেখা গেছে। ইসরাইল এই অঞ্চলে কঠিন সতর্কতা জারি করেছে। এতে তেলআবিবের কয়েকদিনের ভারী হামলায় অঞ্চলটি খালি হয়ে পড়েছে। এদিকে হিজবুল্লাহ’র দাবি তারা বুধবার সকালে লেবাননের আদাইসেহ শহরে অনুপ্রবেশকারী ইসরাইলি বাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করেছে।
ইরান ইসরাইলের ওপর মঙ্গলবারের হামলাকে প্রতিরক্ষামূলক হিসেবে বর্ণনা করেছে। ইরানের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা জানিয়েছে, তিনটি ইসরাইলি সামরিক ঘাঁটি লক্ষ্যবস্তু করেছে ইরান। তেহরান বলেছে, তাদের নেতাদের হত্যা এবং লেবাননে হিজবুল্লাহ এবং গাজায় আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে ইসরাইলে গত মঙ্গলবার রাতে হামলা চালিয়েছে ইরান।
পাল্টা হামলা চালালে ইসরাইলের প্রতিটি স্থাপনাকে টার্গেট করবে তেহরান
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর হুঁশিয়ারির পর এবার পাল্টা হামলার সতর্কবার্তা দিয়েছে ইরান। দেশটির সামরিক বাহিনীর জয়েন্ট চিফ মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি তেলআবিবকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, যদি ইসরাইল পাল্টা হামলা চালায় তাহলে তাদের প্রতিটি স্থাপনাকে টার্গেট করবে তেহরান। ইরানের ওই সামরিক কর্মকর্তা আরও বলেছেন- যদি ইসরাইল তাদের অপরাধ অব্যাহত রাখে এবং আমাদের সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতার বিরুদ্ধে কিছু করতে চায় তাহলে পরবর্তী হামলা মঙ্গলবার রাতের হামলার কয়েকগুণ শক্তিশালী হবে।
তেলআবিবের সমস্ত অবকাঠামোকে লক্ষ্যবস্তু করার হুঁশিয়ারিও দিয়েছে তেহরান। মোহাম্মদ বাঘেরি বলেছেন, ইসরাইলকে মোকাবিলা করতে ইরানের বিপ্লবী রেভ্যুলুশনারি গার্ড কর্পসের সদস্যরা প্রস্তুত রয়েছে। মঙ্গলবার রাতে যে ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইসরাইলে হামলা করা হয়েছিল তার চেয়েও শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র তাক করে ময়দানে প্রস্তুত আছে ইরানের ওই বিশেষ বাহিনী। ইরানের হামলার পর এক নিরাপত্তা বৈঠকে তেহরানকে লক্ষ্য করে কড়া বার্তা দেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘ইরান ওই রাতে একটি বড় ভুল করেছে- এর জন্য তারা মাশুল দেবে।’
ইসরাইলি সেনা নিহত: গাজার দক্ষিণে এক লড়াইয়ে নিহত হয়েছে ইসরাইলের চার সেনাসদস্য। বুধবার এ কথা স্বীকার করেছে ইসরাইল ডিফেন্স ফোর্সেস (আইডিএফ)। নিহত চার সেনাসদস্য হলো- গিভাতি ব্রিগেডের ডেপুটি কোম্পানি কমান্ডার ক্যাপটেন ডানিয়েল মিমোন তোয়াফ (২৩), ৪০১ আর্মার্ড ব্রিগেডের ৫২তম ব্যাটালিয়নের প্যারামেডিক স্টাফ সার্জেন্ট আগাম নাইম (২০), স্টাফ সার্জেন্ট অমিত বকরি (২১) ও স্টাফ সার্জেন্ট ডোতান শিমোন (২১)। ওদিকে লেবাননের হিজবুল্লাহও দাবি করেছে তারা ইসরাইলি কয়েকজন সেনাকে হত্যা করেছে। কতোজন সে বিষয়ে নিশ্চিত করেনি তারা। লেবানন সীমান্তের কাছে একটি টানেল থেকে হিজবুল্লাহ ইসরাইলি সেনাদের ওপর হামলা চালায়। তাতে বেঁচে যাওয়া একজন অবশ্য বলেছেন, তার ইউনিটের সবাই আহত হয়েছেন। তবে তারা সরে যেতে সক্ষম হয়েছেন। ইসরাইলি সেনাদেরকে লেবাননের ওদাইসিয়ে শহরের কাছে অ্যাম্বুস বা ঘেরাও করে এই হামলা চালানো হয়।
ইসরাইলি দূতাবাসে হামলা: লেবাননে স্থল আগ্রাসন শুরুর পর কোপেনহেগেন ও স্টকহোমে ইসরাইলি দূতাবাসে হামলা হয়েছে। মঙ্গলবার স্থানীয় সময় প্রায় ৬টার দিকে স্টকহোমে ইসরাইলি দূতাবাসে কমপক্ষে এক রাউন্ড গুলি করা হয়েছে। এর প্রায় ৯ ঘণ্টা পর ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে দু’টি বিস্ফোরণ হয়েছে। তবে কোনো ঘটনায় কেউ আহত হননি। সন্দেহভাজনদের এবং কী উদ্দেশ্যে এই হামলা হয়েছে তা জানার চেষ্টা করছে দুটি দেশই।
নাগরিকদের সরিয়ে নিচ্ছে চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া: পরিস্থিতির ক্রমশ অবনতি হচ্ছে। তাই লেবানন থেকে নিজেদের নাগরিকদের সরিয়ে নেয়া শুরু করছে চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া। বুধবার চীন বলেছে, লেবানন থেকে তারা কমপক্ষে ২০০ নাগরিককে সরিয়ে নিয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া অবিলম্বে ইসরাইল ও লেবানন সহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্য অংশ থেকে তাদের নাগরিকদের উদ্ধারে সামরিক বিমান ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছে। অন্যদিকে নাগরিকদের অবিলম্বে সরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে বৃটেন।