সরকারি চাকরিতে যৌক্তিকভাবে কোটা সংস্কারের দাবিতে গত কয়েকদিনের মতো বুধবার সকাল থেকে আন্দোলন শুরু করে শিক্ষার্থীরা। সর্বোচ্চ আদালত কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপনে স্থিতাবস্থা দিলেও কর্মসূচি চালিয়ে যাবার ঘোষণা দিয়েছে আন্দোলনকারীরা।
সকল গ্রেডে যৌক্তিকভাবে ন্যূনতম কোটা রেখে সংস্কারের এক দফা এক দাবিতে পহেলা জুলাই থেকে আন্দোলন করছে শিক্ষার্থীরা।
এ সপ্তাহে দুইদিন শিক্ষার্থীরা সড়ক ও রেল যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়ার মতো কর্মসূচী পালন করেছে, যার নাম দিয়েছে তারা 'বাংলা ব্লকেড'। এরই ধারাবাহিকতায় বুধবারও পুরো দেশব্যাপী অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে শিক্ষার্থীরা।
ঢাকায় সারাদিন যা ঘটেছে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে সকাল দশটা থেকে জড়ো হয় শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল ও বিভাগের ব্যানারে কোটা সংস্কারের দাবি নিয়ে এখানে জড়ো হতে থাকে তারা।
কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে থেকে শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে পুরো ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে। এরপর বেলা বারটায় শাহবাগ মোড় অবরোধ করে তারা।
এখানে জড়ো হয়ে বসে যৌক্তিকভাবে কোটা সংস্কারের দাবিতে স্লোগান দেয় ছাত্র-ছাত্রীরা। এ সময় চারদিকের রাস্তায় ব্যারিকেড দেয়া হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক সদস্য মোতায়েন ছিল।
এ সময় শিক্ষার্থীরা গান, কবিতা-আবৃত্তি, নানা ধরনের সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে চালিয়ে যান।
এ সময় মাইকে আন্দোলনকারীরা জানায়, অনাবাসিক এক ছাত্রীকে প্রথমে বাসা থেকে আসতে অনুমতি দেয়া হয়নি। পরে তার মা নিজে নিয়ে এসে আন্দোলনের সাথে একাত্মতা পোষণ করেছেন। একইসাথে ওই ছাত্রীর মা তাদের খাওয়ার জন্য পাঁচশ টাকা দিয়েছেন বলে জানানো হয়। এতে উল্লসিত হয়ে ওঠে শিক্ষার্থীরা।
এরই মধ্যে বেলা পৌনে একটা নাগাদ হাইকোর্টের রায়ে আপিল বিভাগ এক মাসের স্থিতাবস্থা দিয়েছে এ খবর পাওয়া যায়।
বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করে হাইকোর্টের দেয়া রায়ে স্থিতাবস্থা দেন। চার সপ্তাহ পর এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানি হবে। এ সময়কালে সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে সরকারের দেয়া পরিপত্র বহাল থাকবে।
এ সময় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতি। ফলে আন্দোলন কর্মসূচি চলবে কিনা এমন প্রশ্ন করা হয় শিক্ষার্থীদের কাছে। তারা জানান, আদালতের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা থাকলেও নির্বাহী বিভাগের কাছে এক দফা দাবি। ফলে তাদেরকেই এ সমস্যার সমাধান করতে হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, বারবার বিভিন্ন পক্ষ আদালতে গেলে সেটা বাতিল বা স্থগিত করা হচ্ছে। পরে আবার হবে না তার নিশ্চয়তা নেই। আমরা কি একমাস পরপর তাহলে রাস্তায় নামবো? তাই একবারেই এই সমস্যার সমাধান চাই। এখন যেহেতু রাস্তায় নেমেছি তাই এটার একটা স্থায়ী যৌক্তিক সমাধান হোক চাই। সেটা নির্বাহী বিভাগের পক্ষেই সম্ভব। জাতীয় সংসদে আইন পাস করে নতুন পরিপত্র করে এটা করতে পারে।
শিক্ষার্থীদের দাবি, শুধু দুইটি গ্রেডে নয় বরং সকল গ্রেডে যৌক্তিকভাবে ন্যূনতম কোটা রেখে সংস্কার করতে হবে। বিভিন্ন ধরনের লেখা সংবলিত ব্যানার নিয়ে এ সময় সমাবেশ করে ছাত্র-ছাত্রীরা।
তাসনিম তামান্না নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, সকল বৈষম্যমূলক কোটা নিরসন করে পাঁচ শতাংশ কোটা বহাল রাখুক। এটা আমাদের এক দফা এক দাবি।
শিক্ষার্থীরা জানান, সংবিধান অনুযায়ী অনগ্রসর, উপজাতি, প্রতিবন্ধীসহ নানা ধরনের গোষ্ঠীর জন্য ন্যূনতম হারে কোটা রাখতে হবে। অর্থাৎ সব পক্ষের সাথে আলোচনা করে এর সর্বজনসম্মত সমাধান দাবি তাদের।
ফাহমিদা মিনা নামে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, প্রতিবন্ধী কোটা দরকার আছে, উপজাতি কোটা দরকার আছে। কিন্তু সেটা একটা নির্দিষ্ট লিমিটের মধ্যে থাকা উচিত।
২০১৮ সালের প্রজ্ঞাপন নিয়ে কোন কথা নয় বরং সরকারি চাকরির সকল গ্রেডে পুরো কোটা পদ্ধতি সংস্কার দাবি করেন তারা।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সহ-সমন্বয়ক সানজানা আফিফা অদিতি বলেন, ২০১৮ এর পরিপত্র আসুক আর না আসুক। আমার দাবি এটা বাতিলও না, এটা আসাও না। আমার দাবি কোটা সংস্কার। ওটার সাথে আমাদের দাবির কোন সম্পর্ক নেই।
জনগণের ভোগান্তি
শাহবাগে দুইটি হাসপাতাল রয়েছে। চারদিকের রাস্তা বন্ধ থাকায় কোন যানবাহন ছিল না এ এলাকায়। ফলে ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ মানুষ। অনেকেই হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যানবাহন না পাওয়ায় পায়ে হেঁটে রওনা দেন গন্তব্যে। আবার অনেককেই দেখা যায় বেশি ভাড়ায় রিক্সা নিতে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ক্যান্সারের চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন একজন নারী। তিনি জানান, আজকে অবরোধের কথা জানতেন না। চিকিৎসার পর এক ঘণ্টা ধরে শাহবাগে অপেক্ষা করছেন। কিন্তু কোন যানবাহন না থাকায় ভোগান্তিতে পড়েছেন।
ঢাকায় বিভিন্ন পয়েন্টে শিক্ষার্থীদের অবরোধে কার্যত অচল হয়ে পড়ে পুরো ঢাকা। ফার্মগেট, মৎস্য ভবন, মহাখালী, সায়েন্স-ল্যাব, কাকরাইল মোড়সহ বিভিন্ন পয়েন্টে অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা।
মৎস্য ভবন মোড়ে দেখা যায় শিক্ষার্থীরা গাছের ডাল ফেলে এবং ব্যারিকেড দিয়ে রাস্তা অবরোধ করেছেন। একটি বেঞ্চে নারী ছাত্রীরা বসে আড্ডা দিচ্ছেন।
এখানে একটি মোটরসাইকেলে যাত্রী রাস্তা পার হতে চাইলে বাধা দেয় শিক্ষার্থীরা। এ সময় ওই যাত্রী শিক্ষার্থীদের দাবির সাথে একমত বলে জানান। তবে, জনগণের দুর্ভোগের কারণ না হতেও তাদের অনুরোধ করেন।
তবে, বেশিরভাগ পয়েন্টে অ্যাম্বুলেন্স, অসুস্থ রোগী রয়েছে এমন যানবাহন এবং গণমাধ্যমের গাড়ির বিষয়ে শিথিল মনোভাব দেখা গেছে শিক্ষার্থীদের। এসব যানবাহনে যাতে বাধা না দেয়া হয় এমন ঘোষণা দিতে দেখা যায় তাদের। ফলে এসব যানবাহন চলাচলে কোন সমস্যা দেখা যায়নি।
অবরোধের কারণে সকাল থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত দূরপাল্লার বাস তেমন একটা ছেড়ে যায়নি। তবে আড়াইটায় যানবাহন চলাচল শুরু করলে মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে বাস ছাড়া শুরু হয়।
বিনিময় বাসের সুপারভাইজার রফিকুল ইসলাম বলেন, সকাল এগারটার আগে পর্যন্ত বাস চলছিল। কিন্তু এগারটার পরে দূরপাল্লার বাস যেতে পারেনি। এগারটা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত বাস ছাড়েনি ।