দেশব্যাপী স্বরণকালের রেকর্ড দাবদাহে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। গরম ও অস্বস্তিতে হাঁসফাঁস অবস্থা মানুষের। বাতাসের আর্দ্রতার আধিক্যে ভ্যাপসা গরমে নাভিশ্বাস দশা। বহু জনপদে থমকে গেছে স্বাভাবিক জনজীবন। হাঁসফাঁস করছে প্রাণিকুল। রাস্তাঘাট সড়কে পিচ গলছে। প্রতিদিন বাড়ছে উষ্ণতা। তীর্যক সূর্যের অসহনীয় তাতানো তাপের কারণে জনশূন্য হচ্ছে শহর-নগর-পল্লিপথ। ঝাঁ ঝাঁ করছে চারিদিক। রৌদ্রের প্রখর তাপে গলে যাচ্ছে সড়কের পিচ। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ফসল। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্রমেই বাড়ছে তাপমাত্রা। আগামী দিনগুলোয় সারা দেশে দাবদাহ আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে টানা দাবদাহের মধ্যে সোমবার দেশের ইতিহাসে তৃতীয় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে চুয়াডাঙ্গায়। আর ঢাকায় তাপমাত্রা উঠেছে ৪০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, যা এ মৌসুমে ঢাকায় সর্বোচ্চ। এ ছাড়া খুলনা, সাতক্ষীরা, নড়াইল, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরে গরমের তীব্রতায় মারাত্মক ভোগান্তি বেড়েছে সাধারণ মানুষের।
এ বৈরী আবহাওয়ায় চুয়াডাঙ্গা, গাজীপুর ও পাবনায় হিট স্ট্রোকে তিনজন মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। হাসপাতালগুলোয় অসুস্থ রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সাতদিন ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। এর ফলে ঈদের ছুটির পর এসব প্রতিষ্ঠান আজ খুলছে না। একই সঙ্গে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোয় ক্লাস অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। প্রচণ্ড গরমের কারণে অনলাইনে ক্লাস নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটির বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল সাংবাদিকদের বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরামর্শক্রমে এবং আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাসের পরিপ্রেক্ষিতে দেশে চলমান তাপপ্রবাহ ও হিটওয়েভের পূর্বাভাস দেখে কয়েকদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটলে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে পুনরায় সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হতে পারে।
এদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণার পর শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে একধরনের স্বস্তি দেখা গেছে। তারা বলছেন, গরমে এমনিতে অস্বস্তিতে থাকতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকলে ক্লাস-পরীক্ষাসহ নানা ধরনের চাপ থাকবে। তাই তীব্র গরমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখায় একধরনের প্রশান্তি কাজ করছে তাদের মাঝে।
আবহাওয়াবিদরা জানান, বাতাসে জলীয় বাষ্পের আধিক্য থাকায় মানুষের শরীরে অস্বস্তি বেশি ছিল। আবহাওয়া অধিদপ্তরের শনিবার সন্ধ্যা ৬টার প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৪৪টি পর্যবেক্ষণাগারের মধ্যে ১২টিতেই ৪০ ডিগ্রির বেশি তাপমাত্রা ছিল। এছাড়া দেশের অন্যান্য স্থানেও মৃদু থেকে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। তাপমাত্রা ৪০-৪১.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলেই তা তীব্র তাপপ্রবাহ হিসাবে গণ্য করা হয়। ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে উঠলে তা অতি তীব্র দাবদাহ বলা হয়।
তীব্র এ গরমে রাজধানীর হাসপাতালগুলোয় রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। প্রচণ্ড দাবদাহে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীদের মহাখালীর আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) বা কলেরা হাসপাতালে ভিড় করতে দেখা গেছে।
আইসিডিডিআর,বির অ্যাসিসটেন্ট সায়েন্টিস্ট শোয়েব বিন ইসলাম বলেন, গরমের কারণে সবাই পিপাসার্ত থাকে। বিশেষ করে দরিদ্র শ্রেণির মানুষ যারা বেশির ভাগ সময়ে বাইরে থাকেন। তাই তৃষ্ণা মেটাতে অনেকেই অনিরাপদ পানি পান ও অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে থাকেন। এতে ফুড পয়জনিং থেকে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন। এছাড়া টাইফয়েড ও পানিবাহিত হেপাটাইটিস, জন্ডিস হওয়ার আশঙ্কাও থাকে। এখন হাসপাতালে যে রোগী পাচ্ছি, এর বেশির ভাগই পানিবাহিত ডায়রিয়া রোগী।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. ফারহানা আহমেদ স্মরণী বলেন, সাধারণত দেশে মার্চ-এপ্রিলে গরমের তীব্রতায় শিশু ও বয়স্করা বিভিন্ন ধরনের ভাইরাল ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে থাকে। এবার বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে প্রায় সব ভাইরাসই স্ট্রেইন বা পরিবর্তন করতে শুরু করছে। ফলে শিশুরা কোন ভাইরাস দ্বারা রোগাক্রান্ত হচ্ছে, স্পষ্ট করে বলা মুশকিল। তবে ঘরে ঘরে শিশু ইনফ্লুয়েঞ্জাসহ বিভিন্ন ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, হাসপাতালে ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে শীতজনিত ঠান্ডা-কাশির রোগী থাকলেও মার্চ-এপ্রিলে এসে নিউমোনিয়া রোগী বাড়ছে।
চলমান তাপপ্রবাহে সবজি জাতীয় ফসলের ক্ষতির আশঙ্কায় রয়েছেন কৃষক। ঘূর্ণিঝড়ের শঙ্কায় পাকা ধান কাটতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন কৃষক-শ্রমিকরা। আম, কাঁঠাল, লিচু এবং ড্রাগন ফলের ফুল-ফল ঝরে যাচ্ছে। তীব্র পানি সংকট বিরাজ করছে গোটা দক্ষিণাঞ্চলে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ার কারণে যশোরসহ গোটা দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে পানি সংকট দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব জেলার অধিকাংশ অগভীর নলকূপে পানি উঠছে না।
এদিকে, যশোর-নড়াইল, যশোর-ঝিনাইদহ ও যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের কিছু কিছু স্থানে তাপপ্রবাহের কারণে বিটুমিন গলে যাচ্ছে। রাস্তায় যানবাহন চলাচল সীমিত হয়ে পড়েছে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সাধারণত সড়কে যে পিচ ব্যবহার করা হয় তা ৬০-৭০ গ্রেডের। এর গলনাঙ্ক ৪৮ থেকে ৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ তাপমাত্রা ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠলে পিচ গলার কথা। কিন্তু তার অনেক আগেই পিচ গলে যাচ্ছে।
আবহাওয়াবিদ এ কে এম নাজমুল হক বলেন, আবহাওয়া নিয়ে সহসাই কোনো সুসংবাদ নেই। দেশের ওপর দিয়ে চলমান মৃদু ও মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে। জলীয় বাষ্পের আধিক্যের কারণে অস্বস্তি আরও বৃদ্ধি পেতে পারে।
বৃষ্টির সুখবর দিয়ে আবহাওয়াবিদ ড. আবুল কালাম মল্লিক বলেন, গত ৭৬ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে এবারের তাপপ্রবাহ। তবে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে দেশজুড়ে টানা বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে সিলেট, চট্টগ্রাম, বরিশাল, ময়মনসিংহ ও ঢাকা বিভাগে এই বৃষ্টির প্রকোপ বেশি থাকবে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক আজিজুর রহমান বলেন, বৃষ্টির ফলে মে মাসের ২ থেকে ৭ তারিখের ভেতরে তাপমাত্রা কমে আসবে। এসময়ে পুরো বাংলাদেশেই বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। তবে ২ মে’র আগে তাপমাত্রা কমার সম্ভাবনা নেই।
এদিকে ঢাকার তাপমাত্রা আজ বুধবার কিছুটা বেড়েছে। আজ ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৯ দশমিক ৩, যা মঙ্গলবার ছিল ৩৮ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সোমবার ছিল ৪০ দশমিক ৩ ডিগ্রি, রবিবার ছিল ৩৯ ডিগ্রি। এর আগের দিন শনিবার ছিল ৩৭ দশমিক ৪ ডিগ্রি। সে হিসেবে আজকের তাপমাত্রা কিছুটা কম। কিন্তু বাতাসে জ্বলীয়বাষ্পের আধিক্যের কারণে অস্বস্তিকর গরমের তীব্র অনুভূত হচ্ছে।
আবহাওয়াবিদ শাহানাজ সুলতানা বলেন, কাল বৃষ্টি হতে পারে ঢাকার আশেপাশের জেলাগুলোতে। এতে তাপমাত্রা কিছুটা কমে আসবে বলে আমরা আশা করছি। তবে মে মাসে গরম কমে যাবে এটা বলা যাবে না। এপ্রিল-মে মাস স্বাভাবিকভাবেই তাপমাত্রা অনেক বেশি থাকে। গরমের অনুভূতি বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক।
চুয়াডাঙ্গা ও যশোর বাদে মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে বুধবার বেলা ৩ টা পর্যন্ত ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রির ওপরে থাকা জেলাগুলো হচ্ছে– খুলনা, পাবনা, রাজশাহী, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও কুষ্টিয়া৷ এসব এলাকার ওপর দিয়ে মাঝারি থেকে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে।
এদিকে আবহাওয়া অধিদফতরের ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে বলা হয়, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, পাবনা, রাজশাহী, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার ওপর দিয়ে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ এবং টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, নওগা, সিরাজগঞ্জ, দিনাজপুর ও খুলনা বিভাগের ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এছাড়া দেশের অন্য এলাকায় মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে।