মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে আজ শপথ নিচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। স্থানীয় সময় সোমবার (২০ জানুয়ারি) দুপুরে তিনি শপথ নেবেন। এর মধ্য দিয়ে ট্রাম্প যুগ শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই শুরু হচ্ছে না, পরাশক্তি দেশ হিসেবে তার প্রভাব পড়বে বিশ্বজুড়েই।
শপথ অনুষ্ঠানে বিশ্বের প্রায় সব দেশের পক্ষ থেকেই প্রতিনিধিরা যোগ দিচ্ছেন। এদিকে শপথের আগেই মার্কিন প্রশাসনে ব্যাপক পরিবর্তনও ঘটতে শুরু হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে কেন্দ্রীয় আইনসভা ভবন অর্থাৎ কংগ্রেস ভবনে। ইউএস ক্যাপিটল বা ক্যাপিটল বিল্ডিং নামের এই ভবন ওয়াশিংটন ডিসির সিয়াটল কাউন্টিতে আবাসিক এলাকা ক্যাপিটল হিলে অবস্থিত। ভবনটি ক্যাপিটল হিল নামেও পরিচিত। ক্যাপিটল ভবনের পশ্চিম লনে আয়োজন করা হয়েছে শপথ অনুষ্ঠানের।
নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের রানিং মেট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সও এদিন শপথ নেবেন। নির্ধারিত সময় অনুযায়ী ২০ জানুয়ারি শুক্রবার স্থানীয় সময় ভোর ৬টায় নিরাপত্তা ফটকগুলো খুলে দেয়া হবে।
সকাল সাড়ে ৯টায় শুরু হবে কনসার্ট। ক্যাপিটল ভবনে মূল অনুষ্ঠান শুরু হবে বেলা ১১টায়। আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে দুপুরে। ডোনাল্ড ট্রাম্পকে শপথবাক্য পাঠ করাবেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি জন রবার্টস।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের মূল ব্যস্ততা শুরু হয়েছে গতকাল থেকেই। এদিন ভার্জিনিয়ার অরলিংটনে জাতীয় সমাধিক্ষেত্রে দেশটির বীর সেনানীদের সমাধিতে শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ শুরু করেছেন।
শপথ অনুষ্ঠানে যারা আমন্ত্রণ পেয়েছেন
ট্রাম্পের শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন বিশ্ব রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, ব্যবসায়ী ও সেলিব্রেটিদের মধ্যে যারা ট্রাম্পের ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন তাঁরা। অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিতদের তালিকায় রয়েছেন বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বনেতা।
এর মধ্যে ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি, আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট জাভিয়ের মিলেই, এল সালভাদরের প্রেসিডেন্ট নাইব বুকেলে ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর উল্লেখযোগ্য।
এ ছাড়া জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী টাকেশি ইওয়া ও হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবানও এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। চীনের শি জিন পিং ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও তারা তাৎক্ষণিক তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেননি।
অন্যদিকে, ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট জায়ার বোলসোনারো আইনি জটিলতার কারণে অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারবেন না।
অনুষ্ঠানে পারফর্ম করবেন জনপ্রিয় গায়িকা ক্যারি আন্ডারউড, ৭০ দশকের ডিস্কো ব্যান্ড ভিলেজ পিপল ও লি গ্রিনউড। এ ছাড়া র্যাপার ওয়াকা ফ্লকা ওফ্লম এবং অভিনেতা সিলভেস্টার স্ট্যালোনের মতো সেলিব্রেটিরাও অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন।
ব্যবসায়ী নেতাদের মধ্যে টেসলার ইলন মাস্ক, মেটার মার্ক জাকারবার্গ, অ্যামাজনের জেফ বেজোস ও অ্যাপলের টিম কুক অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন বলে জানা গেছে। অনুষ্ঠানে সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, জর্জ ডব্লিউ বুশ, বারাক ওবামা এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন উপস্থিত থাকবেন। যদিও মিশেল ওবামা অনুপস্থিত থাকার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
প্রশাসনে ব্যাপক পরিবর্তন
নবনির্বাচি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শপথ গ্রহণের পর থেকেই দেশটির ফেডারেল সরকারের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরও জোরদার করতে প্রস্তুত। ট্রাম্প ও তাঁর মিত্রদের দাবিকৃত ‘ডিপ স্টেট’ ভেঙে দেওয়ার পরিকল্পনায়ও তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের ‘গভীর রাষ্ট্র’ নির্মূলের দায়িত্বে যাদের রাখা হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মনোনীত পাম বন্ডি, এফবিআইয়ের পরিচালক মনোনীত কাশ প্যাটেল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মনোনীত মার্কো রুবিও, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়াল্টজ, শিক্ষামন্ত্রী প্রার্থী লিন্ডা ম্যাকমাহন এবং ইলন মাস্ক ও বিবেক রামাস্বামী। তাঁরা ট্রাম্পের প্রশাসনিক দক্ষতা বাড়ানোর কার্যক্রমের নেতৃত্ব দেবেন। ট্রাম্পের ট্রানজিশন টিম এ বিষয়ে নির্ধারিত সময়সূচি নিয়ে কোনো তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। কারণ, এই পরিবর্তনে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল নিয়মকানুন অনুযায়ী কয়েক মাস লেগে যেতে পারে।
ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম দিনেই একটি নির্বাহী আদেশ জারি করতে পারেন। যার মাধ্যমে ফেডারেল সরকারের প্রায় ৫০ হাজার স্থায়ী কর্মীর চাকরির সুরক্ষা বাতিল করা হবে। এতে এসব পদে স্থায়ী কর্মীদের পরিবর্তনে নিজের পছন্দের ও অনুগত লোকদের নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।
এ ছাড়া, ট্রাম্প প্রশাসন যত দ্রুত সম্ভব ফেডারেল সরকারের বিভিন্ন বিভাগে হাজারো রাজনৈতিক নিয়োগ সম্পন্ন করার পরিকল্পনাও করছে। এই পরিকল্পনার উদ্দেশ্য হলো, সরকারের বিভিন্ন স্তরে গভীরভাবে অনুগত লোকদের অন্তর্ভুক্ত করা, যা সাম্প্রতিক কোনো প্রেসিডেন্টের তুলনায় অনেক বেশি।
প্রায় ডজনখানেক শীর্ষ পর্যায়ের নিয়োগপ্রাপ্তদের ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ফেডারেল কর্মক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আনার দায়িত্ব দিয়েছেন বা এই পরিকল্পনার প্রতি তাদের সমর্থন জানিয়েছেন। ট্রাম্পের আগের প্রশাসনে অফিস অব ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড বাজেটের পরিচালক রাশেল ভাউট শিডিউল এফ আদেশ পুনরায় চালু করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন।
নতুন প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে ভিন্নমত পোষণকারী ফেডারেল কর্মীদের চিহ্নিত করার প্রক্রিয়া আগেই শুরু করা হয়। নির্বাচনি প্রচারণায় জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের অধিকার বাতিল করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ১৪তম সংশোধনী অনুযায়ী, যদি কেউ মার্কিন ভূমিতে জন্ম নেয়, তিনি দেশটির নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকার রাখেন।
ট্রাম্প এই আইন পরিবর্তন করার ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, প্রথম দিনেই আমি এই অধিকার বাতিল করব। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি বাস্তবায়নে ব্যাপক আইনি বাধার সম্মুখীন হতে হবে।
ট্রাম্পের আরও একটি বিতর্কিত প্রতিশ্রুতি হলো, ৬ জানুয়ারি ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে হামলায় অভিযুক্তদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা। তিনি বলেছেন, ‘আমি প্রথম দিনেই বিষয়টি বিবেচনা করব।’ টাইম ম্যাগাজিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম ৯ মিনিটের মধ্যেই আমি এ বিষয়ে কাজ শুরু করব।’ ট্রাম্পের সবচেয়ে সাহসী প্রতিশ্রুতির মধ্যে একটি ছিল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করা। তিনি একটি নির্বাচনি প্রচারণায় বলেছিলেন, ক্ষমতায় যাওয়ার আগেই তিনি এই যুদ্ধ শেষ করবেন। কমলা হ্যারিসের সঙ্গে এক বিতর্কে তিনি বলেন, এই যুদ্ধের দূত সমাধান করা হবে। আমি জানি, জেলেনস্কি ও পুতিন কীভাবে কাজ করেন। তাঁদের দুজনের সঙ্গেই আমার ভালো সম্পর্ক এবং তাঁরা দুজনই আমাকে সম্মান করেন। তাঁরা বাইডেনকে সম্মান করেন না।
ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন, মেক্সিকো ও কানাডার সব ধরনের পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবেন। গত বছরের ২৫ নভেম্বর ট্রুথ সোশ্যালের এক পোস্টে ট্রাম্প বলেন, ২০ জানুয়ারি, প্রথম দিনের নির্বাহী আদেশগুলোর একটি হবে মেক্সিকো এবং কানাডার সব পণ্যে শুল্ক আরোপ করা। এটি আমার প্রথম দিনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
অর্থনৈতিক ইস্যু নিয়ে দেয়া প্রতিশ্রুতিতে ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন, তিনি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনেই বাইডেন প্রশাসনের ‘ইলেকট্রিক ভেহিক্যাল (ইভি) ম্যান্ডেট’ বাতিল করবেন। হিউস্টনে নির্বাচনি প্রচারণায় ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘আমি ক্ষমতায় আসার প্রথম দিনেই ‘কুটিল জো’-এর ইলেকট্রিক ভেহিক্যাল ম্যান্ডেট বাতিল করব। জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদন বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ট্রাম্প। ফক্স নিউজে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আমি আমেরিকায় আরও বেশি জ্বালানি তেল উত্তোলন করব। এতে জ্বালানি খরচ কমবে। তবে পরিবেশবাদীরা বলছেন, এই ধরনের পদক্ষেপ জলবায়ু পরিবর্তনের সংকটকে তীব্র করবে।
ট্রাম্প ট্রান্সজেন্ডার নারীদের অধিকার সীমিত করতে চান। ট্রান্সজেন্ডার নারীদের খেলায় অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আমি প্রথম দিনেই ট্রান্সজেন্ডারদের ওপর বাইডেনের আরোপিত সব নীতি বাতিল করব। লৈঙ্গিক পরিচয় নিশ্চিত করা এবং ট্রান্সজেন্ডারদের চিকিৎসা সহায়তা দেয়ার উদ্দেশ্যে বাইডেন সরকারের উদ্যোগ ‘জেন্ডার-অ্যাফার্মিং কেয়ার’ বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাম্প। ট্রাম্প আমেরিকার গাড়িশিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে হিলারি ক্লিনটনকে হারিয়ে প্রথমবার মার্কিন মসনদে বসেন ট্রাম্প। পরের নির্বাচনে জো বাইডেনের কাছে হেরে যান তিনি। আগামী চার বছর যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নানা ইস্যুর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পররাষ্ট্রনীতিতে কতটা ইতিবাচক আবহ তৈরি করতে পারেন ট্রাম্প— সেটি সময়ই বলে দেবে। পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ২০২৮ সালে। ২০২৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত হোয়াইট হাউজসহ মার্কিন ক্যাপ্টেন এখন ট্রাম্প।