“একদিন ক্লাসে ধর্ম শিক্ষক আমাকে বললেন, ‘ওই কালি তুই এ প্রশ্নের উত্তর দে।’ স্যারের এমন কথা শুনে আমি থমকে যাই, মুখ দিয়ে আর ওই প্রশ্নের উত্তর আসেনি। ওইদিন অনেক মন খারাপ হয়েছিল। এই শব্দ আমি নিতে পারিনি। স্যার চলে যাওয়ার পর অনেক কান্না করেছি। ‘কালি’ শব্দটি আমি আমার চার-পাঁচ বছর বয়স থেকেই শুনে আসছি। গায়ের রঙের কারণে স্কুলে শিক্ষকদের কাছ থেকে বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে অনেক অবজ্ঞার শিকার হতে হয়েছে। একসময় মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি। কারও সাথে মিশতাম না, কথা বলতাম না। একরকম বন্দি জীবন।” বলছিলেন- কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী জুঁই।
জুঁই বলেন, ‘একবার এক আত্মীয় আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন। তিনি আমাকে দেখেই বললেন, ‘কালি রে কালি, কেমনে তোরে বিয়া দিব, আল্লা-ই (আল্লাহ) জানে। ১০ লাখ লাগবো (লাগবে)।’ মাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘ওই বেডি (মহিলা), তোর মাইয়ারে (মেয়েরে) স্নো-পাউডার দিনে তিন-চার বার করে লাগা (মাখ)। না হয় বোঝা হইবো’ (হবে)।’
বাস্তবে তা-ই হলো! গায়ের রঙের কারণে বেশ কয়েকবার জুঁইয়ের বিয়ে ভেঙেছে। তবে সে এখন বিবাহিত। গায়ের রঙ নিয়ে বিয়ের দিন এবং বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতে অনেক হেয় প্রতিপন্ন হতে হয়েছে তাকে। এমনকি তার মাকেও এ নিয়ে অনেক কথা শুনতে হয়েছে। জুঁই এখন অন্তঃসত্ত্বা। কিন্তু এ নিয়ে এখন খুবই আতঙ্কিত। সন্তানের গায়ের রঙ যদি কালো হয়, তবে পোহাতে হবে নতুন ঝামেলা। শুনতে হতে পারে নানা কথা। সেই ভয় কাজ করছে জুঁইয়ের মধ্যে।
ডিজিটাল আদমশুমারি ২০২২’র তথ্যমতে, দেশে শিশু-কিশোরের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৩৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ। অর্থাৎ ৬ কোটি ৩৮ লাখ ১৭ হাজার ২৮৯ দশমিক ২ হাজার ২২৪ জন। যা বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় চল্লিশ শতাংশ।
গায়ের রঙ ‘কালো’ এমন অন্তত ১৩ মেয়ে শিশু ও কিশোরীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এদের প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে বর্ণবৈষম্যের শিকার। কেউবা নিজের পরিবারে- মা-বাবা, ভাই-বোনের কাছে। কেউ স্কুলে, আবার কেউ সমাজের অন্যদের কাছে। এদের মধ্যে দু’জন বৈষম্যের শিকার হয়ে বিভিন্ন সময়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন বলেও তিনন্ ি জানিয়েছেন।
তাদেরই একজন নোয়াখালী সরকারি কলেজের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী তানজিনা। তিনি বলেন, ‘আমি লেখাপড়ায় মোটামুটি ভালো। স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সবসময় অংশগ্রহণ করি। কবিতা ও সংগীতে একাধিকবার পুরস্কার পেয়েছি। তবে বাবার আর্থিক অসঙ্গতি আর দেহের রঙের কারণে স্যারদের কাছে খুব একটা কদর পাইনি। বিপরীতে আমার যে সহপাঠীদের গায়ের রঙ ফর্সা, স্যাররা তাদের অনেক আদর-স্নেহ করেন। আর কোনো শিক্ষার্থীর বাবার আর্থিক অবস্থা ভালো হলে তো আর কথাই নেই। মজার বিষয় হচ্ছে সব ধরনের প্রতিযোগিতায় তারাই পুরস্কার পায়। এমনকি যারা শিক্ষকদের কাছে নিয়মিত প্রাইভেট পড়ে, শিক্ষকরা তাদের বেশি যত্ন নেন আমরা যারা অর্থাভাবে প্রাইভেট পড়তে পারি না, শিক্ষকগণ তাদের সঙ্গে খুব একটা কথা বলেন না।’
কথা হয় হাবিবা নামে আরেক শিক্ষার্থীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এসএসসি পরীক্ষার আগে ‘এ’ প্লাস পাবে এমন শিক্ষার্থীদের তালিকা করা হয়েছে আলাদাভাবে গুরুত্ব দিতে। তবে বিষয়টি বেশ গোপনেই করা হয়। অপ্রকাশিত হলেও স্যারদের ব্যবহারে বুঝে গিয়েছিলাম, আমি তালিকায় নেই।’
হাবিবা আরও বলেন, ‘একদিন ক্লাসে বিজ্ঞান শিক্ষক মামুন স্যার আমাদের কোনো একটি বিষয়ে প্রশ্ন করছিলেন। স্যার চাচ্ছিলেন প্রশ্নের উত্তর যেন বিশেষ তালিকার কেউ দেয়। কিন্তু তারা সাড়া দেয়নি। উত্তর আমার জানা ছিল। তাই বারবার স্যারকে বলছিলাম, ‘স্যার আমি বলি?’ স্যার আমার কথায় পাত্তা দিলেন না। এমন অনেকবার হয়েছে। মন খারাপ হয়েছে। জানতাম তালিকা থেকে বাদ পড়লেও আমি ওদের চেয়ে খারাপ না। গায়ের রং এবং পারিবারিক অবস্থার জন্যই আমার মতো অনেক শিক্ষার্থী এমন আচরণের শিকার হচ্ছে।’
অপরদিকে শহরের শিশুদের ৬৬ শতাংশ মনে করে চেহারা বা দৈহিক গঠনের কারণে শিশুরা বৈষম্যের শিকার হয়। ৮০ শতাংশ শিশু মনে করে পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে শিশুরা বৈষম্যের শিকার হয়। ৭৮ শতাংশ মনে করে লিঙ্গের কারণে শিশুরা বৈষম্যের শিকার হয়। ৬৯ শতাংশ মনে করে ধর্মের কারণে, ৭৪ শতাংশ প্রতিবন্ধী হওয়ায়, ৭২ শতাংশ মা-বাবার পেশা, ৭০ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হওয়া এবং ৪৮ শতাংশ রাজনীতির সঙ্গে পরিবারের সম্পৃক্ততার কারণে শিশুরা বৈষম্যের শিকার হয় বলে মনে করে।
গাজীপুর কাপাসিয়ার খিরাটী এ কে উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘স্কুলে শিক্ষার্থীদের বৈষম্যের বিষয়টি একেবারেই উড়িয়ে দিচ্ছি না। তবে খুব বেশি যে হচ্ছে তাও নয়। কখনো কখনো আমাদের অনেক সহকর্মীরা হয়ত বুঝতেই পারেন না যে, তিনি শিক্ষার্থীদের প্রতি বৈষম্য করছেন। তবে প্রাইভেট পড়লে শিক্ষকরা ওই ছাত্রদের একটু আলাদাভাবে দেখে। আসলে এটা এমনিতেই চলে আসে ‘
শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘আসলে আমাদের কাছে সবাই সমান। ওরা আমাদের ছাত্র। ওদের সঠিকভাবে গড়ে তোলাই আমাদের দায়িত্ব।’
‘বৈষম্য’ শিশু-কিশোরদের বিকাশে অন্তরায়!
জন্মের পর থেকে বিভিন্ন পরিবেশে শিশুরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে অহরহ। ফলে জনসংখ্যার বিশাল এই গোষ্ঠীর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজের মনোরোগ বিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. রুবাইয়া খান বলেন, ‘বৈষম্যের কারণে শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশ মারাত্মকভাবে সংকটাপন্ন হতে পারে। তাদের মধ্যে দেখা যায়, বিষণ্নতা, আত্মবিশ্বাসের অভাব ও আক্রমণাত্মক আচরণ।’
ডা. রুবাইয়া খান বলেন, ‘শিশুরা বিশ্বাস করতে থাকে, সে দেখতে সুন্দর না, কেউ তাকে পছন্দ করে না। কিছু শিশু ছোটবেলায় এসব বুঝতে না পারলেও কিশোর বয়সে বুঝতে পারে, তখন শারীরিক বিকাশে ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলে।’
মনোরোগ বিদ্যা বিভাগের এই সহকারী অধ্যাপক আরও বলেন, ‘অনেক সময় দেখা যায় বাবা-মা শিশুদের নেতিবাচক কথা বলেন। তখন শিশুরা বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হয়। এর রেশ শিশুদের মধ্যে অনেক দিন থাকে। তারা সহজে ভুলতে পারে না। একটা সময় কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। আবার দেখা যায়, অনেক শিশু মনে করে বুলিং করা মনে হয় নরমাল। একটা সময় তারাও অন্যকে বুলিং করে।’
বহুলাংশে বর্ণ বৈষম্যের বীজ বপন করছে মা-বাবা!
হেকস এপারের সাবেক প্রোগ্রাম অফিসার শাবনাজ বেগম বলেন, ‘গায়ের রঙ কালো হওয়ার কারণে আমি মায়ের কাছেই বৈষম্যের শিকার হয়েছি। পরিবারের সদস্যরা আমি ও আমার বোনের মধ্যে পার্থক্য করত। পারিবারিক অনুষ্ঠানে কিংবা বিভিন্ন সুযোগ সুবিধায় আমার বোনকে প্রাধান্য দিত। আমাকে কোথাও নিতে চাইতেন না। বাবা বুঝিয়ে দিতেন, আমি যেহেতু কালো তাহলে আমাকে প্রচুর পড়ালেখা করতে হবে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। আর আমার বোন সুন্দরী হওয়ায় তার ক্ষেত্রে পড়ালেখা বা ঘোরাফেরা শিথিল ছিল।’
এ ব্যাপারে কথা হয় শিক্ষক দম্পতি রেখা-পলাশ, ব্যাংকার জসিম উদ্দিন, ইঞ্জিনিয়ার তাবাসসুম আক্তার ঝর্ণা, কৃষক আব্দুল খালেক ও গৃহিণী মাছুমা বেগমের সঙ্গে। তাদের সবার কথায় উঠে আসে, ‘সন্তান যেমনই হোক না কেন, বাবা-মায়ের কাছে তারা পৃথিবীর সেরা সন্তান। তবে চলমান সামাজিক অবস্থা-ই শিশুদের বৈষম্যের জন্য অনেকটা দায়ী।’
শিক্ষক রেখা বেগম মনে করেন, বেশিরভাগ বাবা-মা বৈষম্য বিষয়টাই বুঝেন না। কিংবা কীভাবে বৈষম্য হয় তাও বোঝেন না।
বর্ণবৈষম্যের শিকার বেশি মেয়েরা!
নন্দিতা সুরক্ষার সভাপতি তাহিয়াতুল জান্নাত রেমি বলেন, ‘বর্ণ বৈষম্য শুরু হয় পরিবার থেকেই। দেখতে ফর্সা শিশুটি যখন কৈশোরে পা দেয়, তখন থেকেই তার জন্য ভালো বর ও ভালো ঘর পাবে বলে আশ্বস্ত করতে থাকে সমাজ। অন্যথায় বহু কালো বর্ণের নারীদের মুখে শুনেছি গায়ের রং কালো বলেই লেখাপড়া করে বড় হতে হবে তাদের। অন্যথায় সমাজে তাদের দাম নেই। সমাজ এক রকম দর কষাকষির নিক্তিতে কালো ফর্সা নারীদের পণ্য বানিয়ে ফেলেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘কেবলমাত্র শরীরের রঙ, চুলের ধরন এবং লম্বা খাটোর নোংরা বৈষম্যে দিন দিন চরম মানসিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যায় হাজারও নারী। তবে একদিনেই এমন প্রথার পরিবর্তন সম্ভব নয়, সবার আগে দরকার ব্যক্তি সচেতনতা।’
বেগম রোকেয়া পদকপ্রাপ্ত নারী ও শিশু অধিকার কর্মী এবং জাতীয় সমাজসেবা পরিষদের সদস্য পাপড়ি বসু বলেন, ‘দেশটা তো সবারই। হোক সে অন্ধ, কালো কিংবা প্রতিবন্ধী। পরিবার, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের সব সুযোগ সুবিধা পাওয়ার অধিকার তার আছে। দুঃখজনক হলেও সত্য শিশুদের সঙ্গে নানা অন্যায় আচরণ প্রতিনিয়তই দেখতে হয়। তবে রাষ্ট্র প্রতিনিয়তই এমন আচরণ প্রতিকারের চেষ্টা করছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘শিশুরা বৈষম্যের শিকার প্রথমেই হয় পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে। বিশেষ করে মেয়ে শিশুরাই বর্ণ বৈষম্যের শিকার বেশি হয়ে থাকে। তাও আবার মা-বাবা অথবা পরিবারের সদস্যদের কাছে। রাষ্ট্র শিশুদের অধিকার নিশ্চিতে কাজ করছে। বৈষম্য কমিয়ে আনতে প্রথমেই বাবা-মাকে কাউন্সেলিং করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে তদারকি করতে হবে। শিশুদের সঙ্গে বন্ধুভাবাপন্ন ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা চোখ থাকতে অন্ধ যারা তাদেরকে আগে আলো দেখাতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘যেকোনো বৈষম্যই শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে প্রভাব ফেলে। প্রতিটি শিশুর বিকাশ নির্ভর করে পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশ কতটা বন্ধুসুলভ তার ওপর। বৈষম্য নানাভাবে হতে পারে।’
তার মতে- স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময়, ধর্ম কী, পারিবারের আয় কত, এসব তথ্য লিখতে হয়। এটিও এক ধরনের বৈষম্য। এ প্রশ্নগুলো না থাকলে তেমন কোনো সমস্যা হত না।
অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আরও বলেন, ‘ভারতে একটি আইন পাস হয়েছে, কারও সঙ্গে তুলনা করলে সেটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এতে বোঝা যায় বিষয়টি কতটা সেনসেটিভ। শিশু বৈষম্য নিরসনে পরিবারের সদস্যদের কাউন্সেলিং করা, পাঠ্যবইয়ে সচেতনতামূলক টপিক যুক্ত করা ও মীনা কার্টুনের মতো সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে পরিকল্পিতভাবে তুলে ধরতে হবে।’
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) গবেষক ও সহকারী অধ্যাপক মো. নাজমুল হক মিতা বলেন, ‘এমন সংকট সত্যিই চিন্তার বিষয়। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত হওয়া খুব জরুরি। পাঠ্যপুস্তকে কিছু বিষয় আছে। তবে আরও বিস্তারিত থাকা প্রয়োজন। তাছাড়া সরকার শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত করতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে।’