Published : Friday, 15 December, 2023 at 11:49 PM, Update: 16.12.2023 12:15:36 AM
বুধবার (১৩ ডিসেম্বর) শেষ হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে ১৩ দিনের ধরে চলা জাতিসংঘের বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন (কপ-২৮)। এবারের জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসতে ঐকমত্য প্রকাশ করেছেন কপ-২৮ সম্মেলনে অংশ নেয়া বিশ্বের ১৯৮ দেশের নেতারা। সম্মেলনের শেষ দিনেই জীবাশ্ম জ্বালানি বর্জনের আহ্বানে চুক্তির অনুমোদন করেছেন তারা, যাতে প্রথমবারের মতো তেল, গ্যাস ও কয়লার মতো জীবাশ্ম জ্বালানী থেকে সরে আসার জন্য দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
এর আগে চুক্তির বিষয়বস্তু নিয়ে অংশ নেয়া দেশগুলো একমত্য না হওয়ায় আলোচনা বাড়তি সময়ে গড়িয়েছিলো। মঙ্গলবার তা শেষ হওয়ার কথা থাকলেও প্রায় সারা রাত আলোচনার পর শেষ পর্যন্ত বুধবার পর্যন্ত গড়ায়। সকালে কপ প্রেসিডেন্ট সুলতান আল জাবের চুক্তির নতুন এক খসড়া হাজির করেন। এতে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে এসে দূষণমুক্ত জ্বালানির ব্যবহার এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ‘নেট জিরো’ (যতটা কার্বন নিঃসৃত হবে ততটাই সরিয়ে নেওয়া) লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানোর অঙ্গীকার ছিল। ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলোসহ কিছু দেশ এই খসড়ার ভাষা নিয়ে খানিকটা আপত্তি করলেও শেষ পর্যন্ত সম্মত হয়। সম্মেলনস্থলজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে স্বস্তি, এমনকি কিছুটা উচ্ছ্বাসও।
কপের ইতিহাসে এবারই প্রথম এমন কোনো চুক্তি হলো, যার মাধ্যমে তেল (পেট্রল, ডিজেল) যুগের চূড়ান্ত সমাপ্তি হতে যাচ্ছে বলে ইঙ্গিত মিলল। এই চুক্তি নীতিনির্ধারক ও বিনিয়োগকারীদেরও এ সংকেত দিল যে বিশ্ব জীবাশ্ম জ্বালানির আধিপত্য ভাঙতে এখন ঐক্যবদ্ধ।
১০০টিরও বেশি দেশ কপ২৮ চুক্তিতে কঠোর ভাষায় তেল, গ্যাস ও কয়লার ব্যবহার ‘পর্যায়ক্রমে বন্ধ করার’ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানায়। তবে এ ক্ষেত্রে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন পেট্রোলিয়াম রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংগঠন ওপেকের কাছ থেকে বিরোধিতা আসে। তাদের দাবি, সুনির্দিষ্ট জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ না করেও বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনা সম্ভব।
জলবায়ু পরিবর্তনে ভঙ্গুর অবস্থায় আছেন এমন দ্বীপরাষ্ট্রগুলো মূলত জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বের হয়ে আসার স্বপক্ষে উচ্চকণ্ঠ ছিল। তাদের সমর্থন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, নরওয়ে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আরও অনেক দেশের সরকার।
ঐকমত্য ঘোষণার পর কপ-২৮ এর প্রেসিডেন্ট সংযুক্ত আরব আমিরাতের জাতীয় তেল কোম্পানির প্রধান সুলতান আল জাবের বলেন, বিশ্বনেতারা এই পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে নমনীয়তা দেখিয়েছেন। তারা নিজেদের স্বার্থের চেয়ে সাধারণ স্বার্থকে এগিয়ে রেখেছেন।
চুক্তিটিকে জলবায়ুতে একটি ‘অভাবনীয় পরিবর্তন’ হিসাবে আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, আমরা বহুপাক্ষিকতার প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা পুনরুদ্ধার করতে সহায়তা করেছি। মানবতা একত্রিত হতে পারে তা আমরা দেখিয়ে দিয়েছি।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের জলবায়ু প্রধান ওয়াপকে হোয়েকস্ট্রা চুক্তিটিকে ‘দীর্ঘ বিলম্ব’ বলে অভিহিত করে বলেছেন, জীবাশ্ম জ্বালানি বর্জনের সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে প্রায় ৩০ বছর সময় লেগেছে।
জীবাশ্ম জ্বালানি নিয়ে জাতিসংঘের এই চুক্তিতে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে সৌদি আরব। এবারের জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনের প্রশংসা করে এটিকে ‘মহান সাফল্য’ বলে অভিহিত করেছে দেশটি। কপ-২৮ সম্মেলনে সৌদি কর্মকর্তা আলবারা তৌফিক বলেছেন, প্রথমবারের মতো একটি বিশ্বব্যাপী সফল সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য সব রাষ্ট্রীয় পক্ষের প্রচেষ্টার প্রতি আমি আরব দেশের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
সম্মেলনে রাশিয়ার প্রতিনিধি চুক্তিকে উচ্চাভিলাষী আখ্যায়িত করলেও এর প্রশংসা করে বলেছেন, কার্বন নিঃসরণ কমাতে প্রতিটি পক্ষই তাদের পছন্দনীয় বাস্তবসম্মত উপায় বেছে নিতে পারে।
যুক্তরাজ্যের জলবায়ু মন্ত্রী গ্রাহাম স্টুয়ার্ট বলেছেন, জীবাশ্ম জ্বালানী যুগের অবসান শুরু হলো। আমরা জীবাশ্ম জ্বালানী থেকে সরে আসার অঙ্গীকারের ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ।
অস্ট্রেলিয়ার জলবায়ু মন্ত্রী ক্রিস বোয়েন চুক্তিকে ‘শক্তিশালী ফল’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন দুবাইয়ের আলোচনা হলো একটি ‘গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক’।
বাংলাদেশের প্রতিনিধি প্রধানমন্ত্রীর জলবায়ুবিষয়ক দূত সাবের হোসেন চৌধুরী চুক্তির ভাষাকে স্বাগত জানালেও বলেছেন, সব মনমতো হয়েছে এমন নয়। কিন্তু এই চুক্তির ওপর দাঁড়িয়ে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করলে পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব। আমি নিশ্চিত, এই চুক্তির নানা বিষয় নিয়ে আরো আলোচনা প্রয়োজন। কিন্তু এখান থেকে আমরা আত্মবিশ্বাস নিয়ে যেতে পারব।
এবারের এই সম্মেলন থেকে বাংলাদেশের খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার কোন কারণ নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, বিশ্বের অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও অর্থনৈতিক মন্দার এক পটভূমির মধ্যেই এই জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কারণে এর প্রতি দৃষ্টি কম ছিল। একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রুখতে তৈরি করা তহবিলগুলোতে দিন দিন অর্থ সংস্থান কমে যাওয়ার কারণে এর থেকে খুব বেশি প্রত্যাশাও ছিল না।
কোস্ট ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, আমরা যদি আশা করি, খুব বেশি লাভ হবে না। আমাদেরকে নিজেদের পয়সা দিয়েই ডেল্টা প্ল্যান বলেন, নিজেদের সুরক্ষা বলেন, আমাদেরকেই করতে হবে। তার সাথে তো ইকোনমিক ক্রাইসিস আছেই। তাই আমরা কিন্তু সামনের দিনগুলোতে ভয়াবহ একটা জটিল পরিস্থিতিতে পড়তে যাচ্ছি।
তিনি বলেন, আমরা যেখানে ট্রিলিয়ন ডলার আশা করতেছিলাম, সেখানে সব মিলিয়ে বাংলাদেশ অ্যাডাপটেশন ফান্ডের ২০০ মিলিয়নের মতো অর্থ পেতে পারে বলে মনে করেন তিনি, যা আসলে প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।
অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবীর বলেন, এই সম্মেলনের সবচেয়ে বড় অর্জন জলবায়ু ক্ষয়ক্ষতি তহবিল গঠন চূড়ান্ত হওয়া। কারণ, বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, তাপপ্রবাহসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে গেছে। এসব দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে জরুরি ভিত্তিতে সহায়তা দিতে হবে। বাংলাদেশ যাতে ওই তহবিল থেকে দ্রুত বরাদ্দ নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের দিতে পারে, সে ব্যাপারে মনোযোগ দিতে হবে।
তিনি বলেন, কপ-২৮ লস এন্ড ড্যামেজ ফান্ডে বিভিন্ন দেশের অংশগ্রহণের সুখবর দিয়ে শুরু হলেও, টানা দুই সপ্তাহ ধরে নানা আলোচনার পরে আশানুরূপ ফল দেয়নি। আমরা বিভিন্ন ফান্ড যেমন গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড, অভিযোজন তহবিল, স্পেশাল জলবায়ু পরিবর্তন তহবিলে বেশকিছু প্রতিশ্রুতি পেলেও, এর ধারাবাহিকতা এবং যথাযথ প্রয়োগের ব্যাপারে সন্দিহান।
তিনি বলেন, জীবাশ্ম জ্বালানী বন্ধে কঠোর প্রতিশ্রুতি বা পদক্ষেপের অভাব রয়েছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রির মধ্যে রাখতে হলে জীবাশ্ম জ্বালানী বন্ধ করা ছাড়া কোন বিকল্প নাই।
অতীতের যেকোনো সময়ে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনের চেয়ে এটি বড় সম্মেলন। তাই এই সম্মেলন ঘিরে সারা বিশ্বের নেতাদের কাছে বিশ্বের মানুষের ছিল অনেক প্রত্যাশা।
কপ২৮ সম্মেলনে মন্ত্রী পর্যায়ের আলোচনায় বাংলাদেশের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন কয়েকটি দাবি উত্থাপন করেছেন। দাবিগুলো ছিল:
১. প্যারিস চুক্তির ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সীমাবদ্ধ রাখতে ২০৩০ সালের জন্য কার্বন নিঃসারণ হ্রাসের প্রতিশ্রুতির উচ্চাকাঙ্ক্ষা সাত গুণ বেশি হওয়া দরকার। এ বিষয়ে প্যারিস জলবায়ু পরিবর্তন চুক্তির লক্ষ্য পূরণের দিকে সম্মিলিতভাবে কোথায় কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে এবং কোথায় হয়নি, তা খতিয়ে দেখতে হবে। কার্যক্রমের অগ্রগতির মূল্যায়নসহ ভবিষ্যতের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও বৈশ্বিক মজুত থেকে সুনির্দিষ্ট মাইলফলকসহ স্পষ্ট পদক্ষেপ দেখতে চায় বাংলাদেশ;
২. প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাংলাদেশকে উন্নত দেশগুলোর প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রদান করতে হবে। সবুজ জলবায়ু তহবিল (জিসিএফ), স্বল্পোন্নত দেশের তহবিল (এলডিসিএফ), অভিযোজন তহবিল (এএফ) এবং জিইএফ ট্রাস্ট তহবিলকে পর্যাপ্ত অর্থসংস্থান দিয়ে শক্তিশালী করতে হবে এবং সেই তহবিলের প্রবেশাধিকার দ্রুত ও সহজ করতে হবে;
৩. প্যারিস চুক্তির সিদ্ধান্তের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ রেখে অভিযোজন ও প্রশমন এবং অনুদানভিত্তিক অর্থায়নের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ ৫০: ৫০ বরাদ্দের ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশের প্রস্তাব হলো, এনএপি বা জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য অভিযোজন তহবিল দ্বিগুণ করা দরকার। কপ-২৬ সম্মেলনে ২০১৯-২০১৫ সময়ের জন্য উন্নত দেশগুলোকে যে ‘কল টু ডাবল অ্যাডাপটেশন ফাইন্যান্স’-এর পরিকল্পনা দেওয়া হয়েছিল, তার অধীনে পর্যাপ্ত অর্থসহায়তা প্রদান করতে হবে।
সম্মেলনের প্রথম দিনেই ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ তহবিলের বিষয়টি দীর্ঘ আলোচনা ও প্রতীক্ষার পর অবশেষে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদিত হয়েছে। এই তহবিলে সংযুক্ত আরব আমিরাত ১০০ মিলিয়ন ডলার, জার্মানি ১০০ মিলিয়ন ডলার, ব্রিটেন ৫১ মিলিয়ন ডলার, যুক্তরাষ্ট্র ১৭.৫ মিলিয়ন ডলার ও জাপান ১০ মিলিয়ন ডলার প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সম্মেলনের প্রথম পাঁচ দিনে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ৮৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি বরাদ্দের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বছরে বাংলাদেশের ক্ষতি ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই ক্ষতি মোকাবিলায় বাংলাদেশের জন্য ৪০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করেছে এডিবি।
এবারের সম্মেলনে ১৯৮ দেশ থেকে প্রায় ৭০ হাজার প্রতিনিধি অংশ নেন, যার মধ্যে ১৪০ দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরাও ছিলেন। যদিও সম্মেলনে অংশ নিতে ১ লাখ ১০ হাজার অতিথি রেজিস্ট্রেশন করেছিলেন। অতীতের যেকোনো সময়ে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনের চেয়ে এটি বড় সম্মেলন। তাই এই সম্মেলন ঘিরে সারা বিশ্বের নেতাদের কাছে বিশ্বের মানুষের ছিল অনেক প্রত্যাশা।
আগামী বছর কপ-২৯ সম্মেলন হবে আজারবাইজানে। দুবাই সম্মেলন থেকে সোমবার (১১ ডিসেম্বর) নতুন আয়োজক দেশ নির্বাচন করা হয়।